মটরযান আইনে কি আছে?


সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর মোটরযান আইন বা এসংক্রান্ত আইন জানার আগ্রহ অনেকে প্রকাশ করছেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবেও কয়েকজন বন্ধু জানতে চেয়েছেন।

চলুন দেখি আমার, আপনার প্রিয়জন সড়ক দুর্ঘটনায় (ধাক্কায় বা পিষে বা অন্যকোনভাবে) মারা গেলে আইনে শাস্তির কি বিধান আছে?

মটর যান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ ইং অনুযায়ী (অনেকগুলো ধারার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিলাম).....

★ অত্যাধিক গতিতে গাড়ি চালনোর শাস্তি প্রথম বার ১ মাস, ২য় বার ৩ মাস জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪২ ধারা অনুযায়ী)
মটর যান
★ বেপরোয়াভাবে বা বিপদজনকভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি ১ম বার ৬ মাস, ২য় বার ৩ বছর জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪৩ ধারা অনুযায়ী)

★ মদ্যপান বা নেশা করে গাড়ি চালানোর শাস্তি ১ম বার ৩ মাস, ২য় বার ২ বছর জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪৪ ধারা অনুযায়ী)

★ মানুষিক বা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গাড়ি চালানোর শাস্তি ১ম বার ৫০০ টাকা, ২য় বার ৩ মাস জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪৫ ধারা অনুযায়ী)

★ রেসিং অথবা গতি পরীক্ষা করলে শাস্তি ১ মাস জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪৮ ধারা অনুযায়ী)

★ ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় গাড়ি ব্যবহার করলে শাস্তি ৩ মাস জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়। (১৪৯ ধারা অনুযায়ী)

মজার ব্যাপার হলো, শাস্তির পরিমানের সাথে 'অথবা জরিমানা অথবা উভয়' লেখা আছে। তারমানে এমন হতে পারে অপরাধী একদিনও জেল না খাটতে পারে যদি তাকে শুধু জরিমানা করা হয়!

দুঃখজনক যে এই অধ্যাদেশের কোথাও এইসব অপরাধে মারা গেলে কি হবে তা বলা হয়নি। তাহলে মারা গেলে (তা মৃতের সংখ্যা যতই হোক) প্রতিকার কি?

ভাবছেন 'দণ্ডবিধি, ১৮৬০ইং'? চলুন চোখ বোলাই দণ্ডবিধিতে ....

একসময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে দণ্ডবিধি'র ৩০২ ধারায় খুন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। পরে আন্দোলনের ঠেলায় সংশোধনী এনে দণ্ডবিধিতে ৩০৪(খ) যোগ করা হয়েছে।

আসুন দেখি দণ্ডবিধি'র ৩০৪(খ) ধারা কি বলে?
★ 'যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সাথে জনপথে যান বা অশ্ব চালিয়ে অপরাধজনক নরহত্যা নয় এমন মৃত্যু ঘটায়, সেই ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদন্ডে, যার মেয়াদ তিন বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা জরিমানা দন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে'।

তারমানে গাড়ি চালকের ওভার স্পিড বা অবহেলায় কেউ মারা গেলে যদি তা 'ইচ্ছাকৃত' না হয় তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর জেল। এক্ষেত্রেও শাস্তির পরিমানের সাথে 'অথবা জরিমানা অথবা উভয়' লেখা আছে। অর্থাৎ আপনি কাউকে 'ইচ্ছাকৃত' মেরে ফেললেও যদি প্রমাণ করতে পারেন সেটা অনিচ্ছাকৃত ছিল, তবে শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল। এমনকি তা এক মাস হতে পারে বা ৬ মাস জেলও হতে পারে বা একদিনও জেল না খেটে জরিমানাও হতে পারে। আবার, অনিচ্ছাকৃত যদি গাড়ির ব্রেকফেল প্রমাণ (অনেক সোজা তা করা) করতে পারেন, তবে শাস্তিও অনেক কমে আসবে। এখানে মৃতের সংখ্যা বিবেচ্য নয়।

অর্থাৎ, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বর্তমান আইন দিয়ে, বিশেষ করে দণ্ডবিধি'র ৩০৪(খ) এর কারণে আপনি কাউকেই খুন করার শাস্তি দিতে পারবেন না। একটা না একটা কারণ দেখিয়ে শাস্তি ৩ বছরের অনেক নিচে নামিয়ে আনা অতি সহজ।

★★★ এবার প্লিজ মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য চোখটা বন্ধ করুন। ভাবুন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালবাসেন যাকে (হতে পারে আপনার সন্তান বা আপনার প্রিয় বাবা বা মা, ভাই বা বোন বা প্রিয়তমা স্ত্রী বা প্রিয়তম
স্বামী বা প্রেমিক বা প্রেমিকা বা বন্ধু) সে রাস্তায় নিরাপদে দাঁড়িয়ে আছে! হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মেরে ফেলে গেল! আপনার প্রিয়জনটি মারা গেল!

চোখটা খুলতে কষ্ট হলো?

আচ্ছা, যখন শুনবেন ঐ গাড়ি চালক দুদিনের মাথায় জামিন পেল! পরে মাত্র ছ'মাসের জেল হলো। কেমন লাগবে?

Comments

Popular posts from this blog

২৬ এর মামলা কি! কেন মারামরি হলেই ২৬ এর মামলা করতে চাই।

কোন দলিলে কত টাকার স্ট্যাম্প লাগবে

সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেফতার ও সামরিক বরখাস্ত কখন এবং কিভাবে হয়।