জেনে নিন বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যার শাস্তির ইতিকথা ও শাস্তি কি?

১৯৮৪ সালের ঘটনা। একদিন চেম্বারে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর এজলাসে উঠার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি কিন্তু পেশকার তখনও কোর্টের কজলিস্ট ও ডাইরিতে সই নেবার জন্য চেম্বারে আসেনি। বিলম্ব দেখে এজলাস পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই, সে বলল- আজ তো খুলনায় হরতাল ডেকেছে তাই বাস চলাচল বন্ধ। পেশকার ত বাসে চড়ে অফিসে আসে তাই আসতে দেরি হচ্ছে।
রোড একসিডেন্ট 
আমি জানতে চাইলাম কী কারণে আজ হরতাল ডেকেছে?উত্তরে সে বলল- আপনি যে স্যার গতকাল এক ড্রাইভারকে সাত বছর জেল দিয়েছেন সে জন্যই পরিবহন শ্রমিকেরা আজ হরতাল ডেকেছে।

বিষয়টি শুনে আমি থ বনে গেলাম। বিচার শেষে রায় দিয়েছি আর সেই রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল! আমি যেন বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলাম না। মামলার ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনার দিন দু’জন লোক রাস্তার পাশে বলে গল্প করছিল ঐ সময় ঘাতক বাসটি অপর একটি বাসকে ওভারটেক করার সময় ঐ দু’জন লোকের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয় ফলো ঘটনাস্থলে একজন লোক মারা যায়। এ মামলাটি সাক্ষ্য প্রমাণে সুপ্রমাণিত হলে আমি একমাত্র ড্রাইভার আসামিকে দন্ডবিধির ৩০৪ বি ধারামতে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড দেই। তার পরের দিনই ড্রাইভারকে জেল দেবার প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়।

বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, আরও বিস্ময়ের পর্বতমালা অপেক্ষা করছিল। পরিবহন শ্রমিক নেতাদের দাবি ছিল দুর্ঘটনাজনিত কারণে কারও মৃত্যু হলেও ড্রাইভারকে জেল দেওয়া যাবে না। যেহেতু আমার প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলন সেহেতু আমি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের কর্মসূচির প্রতি দৃষ্টি রাখতাম। এরপর তারা ড্রাইভারকে প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে একদিন খুলনা বিভাগের সকল জেলায় ধর্মঘট পালন করে। সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে কিছুদিন পর পরিবহন শ্রমিকেরা সারাদেশব্যাপী হরতাল পালন করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। শ্রমিক নেতারা হুমকি দেয়, যদি তাদের দাবি মানা না হয় তবে তারা পুনরায় হরতাল ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশকে অচল করে দেবে। এবার হুমকিতে কাজ হল।

পত্রিকায় দেখলাম মন্ত্রী পর্যায়ের নেতাদের সাথে পরিবহন শ্রমিক নেতারা যৌথ সভা করে শ্রমিক নেতাদের আংশিক দাবি সরকার মেনে নিল।
যানবাহন চালকদের অবহেলা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে কারও মৃত্যু ঘটলে চালকের ঐরূপ কাজকে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দন্ডবিধির ৩০৪ বি ধারাটি প্রণীত হয়। ১৯৮২ সনের ১০নং অধ্যাদেশ দ্বারা এই ধারাটি সন্নিবেশিত হয়। তখন এরূপ নরহত্যার অপরাধের সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান ছিল।পরিবহন চালকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সনের ২১ নং অধ্যাদেশ দ্বারা শাস্তির পরিমাণ ১৪ বছর এর স্থলে ৭ বছর কারাদন্ড করা হয়। আলোচ্য মামলাটি যখন রায় প্রদান করা হয় তখন ৩০৪ বি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর কারাদন্ড এবং অপরাধটি ছিল অজামিনযোগ্য। কিন্তু ১৯৮৫ সনে পরিবহন শ্রমিকদের হুমকির মুখে তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়ে ৪৮নং অধ্যাদেশ দ্বারা ৩০৪ বি ধারাটি সংশোধন করে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ডের স্থলে ৩ বছর কারাদন্ড করা হয় এবং অপরাধটিকে জামিনযোগ্য করা হয়।

সেদিন থেকেই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শাস্তি সংক্রান্ত ৩০৪ বি ধারটি হল দন্তহীন আইন। আইনের বিধান হল জামিনযোগ্য অপরাধে কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত হলে জামিনে মুক্তি পাওয়া তার অধিকার, এটা আদালতের করুণা নয়। কাজেই গাড়ি চালকের অবহেলা বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য কারও মৃত্যু ঘটলে গাড়ি চালক মনে করেন তিনি কোন অপরাধ করেননি, যা হয়েছে তা একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ঢুকামাত্র জামিনে মুক্তি পান, আর ভিক্টিমের স্বজনেরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন।

(সূত্র: বিচারক জীবনের কিছু স্মৃতিকথা; বিচারপতি এ.টি.এম. ফজলে কবীর)

Comments

Popular posts from this blog

২৬ এর মামলা কি! কেন মারামরি হলেই ২৬ এর মামলা করতে চাই।

কোন দলিলে কত টাকার স্ট্যাম্প লাগবে

সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেফতার ও সামরিক বরখাস্ত কখন এবং কিভাবে হয়।