এই শিক্ষার্থীরা, সেই শিক্ষকেরা!

বেল্লাল হোসাইন

নটরডেম কলেজ
নটর ডেম কলেজের বিখ্যাত হিসাববিজ্ঞান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় শীতল চন্দ্র দে স্যার তার ছাত্রদের "ছাপ্পা আড়াই নাম্বার মাল" হিসাবে আখ্যায়িত করতেন। কঠোর ডিভিশন পদ্ধতি বাদ দিয়ে যখন গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল দেয়া শুরু হলো তখন দিন দিন রেজাল্ট ফুলেফেঁপে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু প্রত্যাশিত মানের ছাত্র কম পাওয়া যাচ্ছিল দেখে স্যার আগের মত খেটে পড়াতে উৎসাহ পেতেন না।
তিনি শাসনের ব্যাপারে এতটাই কঠোর ছিলেন যে, কেউ নিজেকে প্রভাবশালী পরিচয় দিলে তার পিঠে স্টিলের স্কেল বাঁকা করে ফেলতেন। আমরা ভয়ে তটস্থ থাকতাম কারন কার উপর শনি কখন উঠে বুঝা যেত না।
স্যারের ক্লাস ছিল টিফিন পিরিয়ডের আগেরটি।কাজেই তার ক্লাস শেষ করে দ্রুত টিফিন খেতে যাবার একটা তাড়া থাকতো। আমি একবার ভুল করে ঘণ্টা পরার পরও স্যার রুমে থাকতেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। টিফিন খেয়ে এসে শুনি আমার উপর হুলিয়া। শিক্ষক অবমাননার দায়ে পরের দিন আমার কঠোর বিচার হবে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ বেজায় খুশি আমার বেহাল অবস্থা দেখে। অবশ্য আমরাও পরের বিপদ দেখে এমন খুশি হতাম মাঝে মাঝে!
আমি বিপদ টের পেয়ে পরের দিন বিচারের আগেই স্যারকে মাঠে একা পেয়ে পা ধরে কান্নাকাটি করলাম। স্যার মাফ তো করলেনই, দোয়াও করলেন। স্যার বললেন, " বিচার করবো বেয়াদবী করার জন্য, যে ছাত্র শিক্ষকের পা ধরে মাফ চাইতে পারে সে তো বেয়াদব না! যাও পড়াশোনা করো।"
ক্লাসে সবাই যখন টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমার বিচারের অপেক্ষা করতে করতে ক্লাসটাই শেষ হয়ে গেল সবাই হুমরি খেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো "স্যার ভুলে যাবার মানুষ না। তুই কেমনে ম্যানেজ করলি বল?"
আমি বললাম বিনয় দিয়ে ম্যানেজ করেছি।
চিকনিকান্দি মাধ্যমিক স্কুলের শ্রদ্ধেয় কাসেম স্যার আমার অসুস্থতার জন্য আমাকে কোলে নিয়ে এসএসসির গণিত পরীক্ষা দিতে নিয়ে যান। এর আগে রাতভর সেবা করেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে নজরুল স্যারের স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই স্নেহশীল স্যার আমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে নটর ডেম কলেজে নিয়ে যান। তার স্কুল ছেড়েছি বলে রাগ পুষে রাখেননি। অথচ ইদানীং কোনো কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া ছাড়লে সেই শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শত্রু ভাবা শুরু করেন।
চিকনিকান্দি স্কুলের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক শ্রদ্ধেয় ইউসুফ স্যার ফোন করেই বলবে কিরে বিলই কেমন আছো। আমার নাম বিকৃত করে বেল্লাল থেকে বিলই বলে। আমরা এতে সম্মানিত বোধ করি। কারণ স্যাররা সবাইকে এমন করেন না। জাহাঙ্গীর স্যার নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন। নটর ডেম কলেজে নতুন ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে জয়েন করেছিল জহির স্যার। তার উৎসাহে আমি আর বিনয় দাস পুরো ইংরেজি টেক্সট বইয়ের শব্দার্থ মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। রনজিত কুমার নাথ স্যার নিজেকে কখনো প্রফেসর বলতেন না। তিনি বলতেন আমার একটাই পদবী সেটা হলো শিক্ষক!
আমাদের সময়ে স্যারদের উপদেশগুলো আমরা হুকুম হিসাবে নিতাম। এখনকার বাচ্চারা হুকুম মানতেই নারাজ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অর্থ না বুঝেই ওরা ব্যক্তিত্ত্বের চর্চা করে।
আজকাল যেমন স্নেহশীল শিক্ষকের অভাব দেখা দিয়েছে,তেমনি অভাব পরেছে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষার্থীর।
ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক মধুর ও প্রতিশ্রুতিশীল না হলে শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশের মান পরতেই থাকবে।
প্রিয় শিক্ষকগণের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। দায়িত্বশীল সব পক্ষের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে আবার গুরু শিষ্যের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক।

লেখকঃ আইনজীবী ও সমাজকর্মী।

Comments

Popular posts from this blog

২৬ এর মামলা কি! কেন মারামরি হলেই ২৬ এর মামলা করতে চাই।

কোন দলিলে কত টাকার স্ট্যাম্প লাগবে

সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেফতার ও সামরিক বরখাস্ত কখন এবং কিভাবে হয়।